মনির হোসেন,যশোর প্রতিনিধি : বাংলাদেশের ফুলের রাজধানী। শীতের ভোরে কুয়াশার চাদর যখন সবেমাত্র সরে যেতে শুরু করে, ঠিক তখনই এই জনপদ জেগে ওঠে এক বর্ণিল ব্যস্ততায়-যা কেবল ব্যবসার নয়, এ যেন মাটি আর মানুষের স্বপ্ন বোনার এক সফল কাব্য। সামনে মহান বিজয় দিবস, আর তার আবাহনে ফুলের রাজ্যে লেগেছে রমরমা বেচাকেনার ঢেউ।
শীত উপেক্ষা করে কাকডাকা ভোর থেকে মহাসড়কের দু’পাশে জমে ওঠে রঙের হাট। ফুলচাষিরা বাইসাইকেল, ভ্যান, বা মোটরসাইকেলের পেছনে করে নিয়ে এসেছেন তাজা গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, গ্ল্যাডিওলাস আর রজনীগন্ধার সুবিশাল পসরা। দূর-দূরান্ত থেকে আসা পাইকারদের হাঁকডাক, দর কষাকষি আর ফুলের সুবাসে বাতাস হয়ে ওঠে ম ম। এটি শুধু একটি বাজার নয়, এ যেন জাতীয় উৎসবের ডালি সাজানোর এক বিশাল কর্মযজ্ঞ।

দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান, দামে ফিরল হাসি
গত কয়েক বছরের লোকসানের আঁধার কাটিয়ে এবার মৌসুমের শুরুতেই দামের ঝলমলে আলো দেখছেন গদখালীর পাঁচ হাজারের বেশি ফুল চাষি। বাজারে ফুলের চাহিদা এখন তুঙ্গে, আর সেই চাহিদার বিপরীতে দামের ঊর্ধ্বগতি যেন চাষিদের মনে নতুন করে আশার সঞ্চার করেছে।
ফুল চাষি মো,শাহীন কিংবা মো,মিজানুর রহমানের মতো অনেকেই বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার ফুলের বাজার খুবই সন্তোষজনক। তাদের আশা, বিজয় দিবস থেকে শুরু করে আসন্ন ইংরেজি নববর্ষের পহেলা জানুয়ারি পর্যন্ত যদি এই উর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকে, তবে বিগত দিনের সব ক্ষতি পুষিয়ে তারা লাভবান হতে পারবেন।
তবে এই আনন্দের মধ্যেও মিশে আছে এক চাপা উদ্বেগ। চাষি কবির হোসেনের কথায় উঠে এল বাস্তব চিত্র, “দাম স্থিতিশীল আছে, এটা ভালো খবর। কিন্তু সার ও কীটনাশকের দাম আকাশছোঁয়া। তার উপর ফলনও কমেছে; আগে এক বিঘা গোলাপ বাগান থেকে যে পরিমাণ ফুল পেতাম, এখন তার চার ভাগের এক ভাগও পাওয়া যায় না। চাহিদার তুলনায় যোগান কম হওয়ায় দাম বেশি পাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু উৎপাদন খরচ বাড়ায় স্বস্তি কম।”
৩০০ কোটি টাকার হাতছানি
এই মৌসুমে গদখালীর অর্থনীতিতে ফুলের সৌরভ কেমন প্রভাব ফেলবে, তার ধারণা দিয়েছেন চাষি ও ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা। গদখালী ফুল চাষি ও ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, “বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে আমাদের চাষিরা অন্তত পাঁচ কোটি টাকার ফুল বিক্রি করবেন বলে আমরা আশাবাদী। তবে এই অঙ্কের চেয়েও বেশি বিক্রি হবে, কারণ জাতীয় দিবসের চাহিদা থাকে ব্যাপক।”
অন্যদিকে, সহ-সভাপতি মঞ্জুর আলম জানান, এই মৌসুমের পুরোটা জুড়ে এই অঞ্চলের চাষিরা সম্মিলিতভাবে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ফুল বিকিকিনি করবেন। এই বিপুল অঙ্কের আশা নিয়ে চাষিরা এখন তাদের স্বপ্নের ফসল বিক্রিতে ব্যস্ত।
ফুলের সাথে বিজয়ের বন্ধন
এই অঞ্চলের কৃষকরা শুধু ফুল চাষ করেন না, তারা যেন দেশের প্রতিটি উৎসবের সঙ্গে নিজেদের শ্রম আর স্বপ্নকে বেঁধে ফেলেন। লাল-সবুজ পতাকার রঙের সঙ্গে এখানকার টাটকা গোলাপ, গাঁদা, আর গ্ল্যাডিওলাসের রঙ মিশে যায় একাকার হয়ে।
ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. নূরুল ইসলামও আশাবাদী, “আমরা সবসময় চাষিদের পাশে আছি, ছত্রাকসহ অন্যান্য রোগবালাই মোকাবিলায় নিয়মিত পরামর্শ দিচ্ছি। বাজারের পরিস্থিতি খুবই ভালো। আশা করা হচ্ছে, মৌসুমের শেষে গদখালীর চাষিরা শুধু লাভবানই হবেন না, দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেবেন তাদের ফসলের সুবাস।”
বিজয়ের আবহে গদখালীর এই জমজমাট দৃশ্য কেবল একটি অর্থনৈতিক সাফল্য নয়; এটি দেশের প্রতি তাদের ভালোবাসা আর কঠোর পরিশ্রমের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। ফুলে ফুলে সজ্জিত এই রাজ্য থেকে তাজা ফুল পৌঁছে যাচ্ছে দেশের প্রতিটি কোণে, বিজয়ের আনন্দকে আরও বেশি বর্ণিল করে তুলতে।
প্রতিনিধির নাম 




















