মনির হোসেন,যশোর প্রতিনিধি: বিএনপি ২৩৭ আসনে প্রথম দফায় মনোনয়ন ঘোষণা করে গত ৩ নভেম্বর। এ তালিকায় যশোরের ৫টি আসন ছিল। আর দ্বিতীয় দফায় ৪ ডিসেম্বর ঘোষণা করে আরো ৩৬টি আসনে। সর্বশেষ তালিকায় ছিল যশোর-৫ (মনিরামপুর) আসনটি। এর মধ্যে দিয়ে যশোরের ৬টি সংসদীয় আসনেই দলটি প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করলো। তবে ৬টির মধ্যে ৪টিতেই মনোনয়ন বঞ্চিত ও তাদের বলয়ের নেতাকর্মীরা ‘বিদ্রোহ’ করেছেন। মনোনয়ন ঘোষণার আগে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা সভা-সমাবেশে বলতেন ‘মনোনয়ন যে নেতাই পান, আমরা তার পক্ষে কাজ করবো।’ ঐক্যের সেই সুর যেন অসুর হয়ে গেছে। ঐক্যের বিপরীতে অনৈক্য- কোথাও বিদ্রোহ করতে দেখা গেছে। এতে ফুরফুরে ইমেজে আছেন নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াত ইসলামী।
সূত্র মতে, যশোর-৩ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী অনিন্দ্য ইসলাম অমিত ছাড়া অন্য ৫টি আসনে ছিল বিএনপির একাধিক প্রার্থী। মনোনয়ন পেতে তারা পৃথকভাবে কর্মসূচি ও শোডাউন যেমন করেছেন। তেমনি মাঝেমধ্যে এক মঞ্চেও দেখা গেছে তাদের। কেন্দ্র, জেলা ও তৃণমূলে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, মনোনয়ন যেই পাবেন তার পক্ষে মাঠে থাকবেন। ধানের শীষকে বিজয়ী করবেন। কিন্তু গত এক মাস সাত দিন আগে মনোনয়ন ঘোষণা করা হলেও যশোর-১, যশোর-২, যশোর-৪ ও যশোর-৬ আসনে বঞ্চিতরা ‘কথা রাখেননি’। তাদের বলয়ের নেতাকর্মীদেরও ধানের শীষের পক্ষে কাজ করতে দেখা যায়নি। উল্টো মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে। তবে যশোর-৩ এবং যশোর-৫ আসনে ধানের শীষ মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে মাঠে আছেন নেতারা।
যশোর-১ (শার্শা) : এ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করা বিএনপির সাবেক দফতর সম্পাদক ও সাবেক এমপি মফিকুল হাসান তৃপ্তি। বঞ্চিত হয়েছেন সাবেক সভাপতি খায়রুজ্জামান মধু, বর্তমান সভাপতি আবুল হাসান জহির ও সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান লিটন। জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন বিএনপির বিভিন্ন সভা-সমাবেশে এই চার নেতা একই সুরে কথা বলেছিলেন। বক্তব্যে তারা বলেছিলেন, ধানের শীষ যে পাবেন তার পক্ষেই কাজ করবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত মধু, হাসান ও লিটনের কথার মিল খুঁজে পাচ্ছেন না কর্মীরা। মনোনয়ন ঘোষণার এক মাস সাতদিন পার হলেও তারা ধানের শীষের পক্ষে মাঠে নামেননি। বরং নিজেদের অনুসারীদের দিয়ে মহাসড়ক অবরোধ করে বিএনপিকে সমালোচনার মুখে ঢেলে দেন। এতে ক্ষুব্ধ হন জেলা ও কেন্দ্রের নেতারা। এ কারণে আবুল হাসান জহির ও নুরুজ্জামান লিটনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় জেলা বিএনপি।
এদিকে, শুধু বঞ্চিত নেতারা নয়; তাদের অনুসারী কিছু কিছু বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের নেতা এখনো ধানের শীষের পক্ষে মাঠে নামেননি। দলের হাইকমান্ড জানতে পেরে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। যুবদলের শার্শা উপজেলা সভাপতি ও বেনাপোল পৌর তিননেতার বিরুদ্ধে শোকজ নোটিশ দেয়। ছাত্রদলের নেতাদের বিরুদ্ধেও একই নোটিশ দেয়া হয়েছে। নোটিশের জবাব দিয়ে তারা ধানের শীষের ভোট করবেন বলে আপাতত রক্ষা পেয়েছেন।
শার্শা উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবুল হাসান জহির বলেন, দলের হাই কমান্ড সারা দেশের মতো শার্শার মনোনয়ন বঞ্চিতদের আগামী শনিবার ডেকেছেন। সেখানে কি হয় সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি। তবে আমরা ধানের শীষের বাইরের কেউ না।
যশোর-২ (ঝিকরগাছা-চৌগাছা) : এ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন কেন্দ্রীয় বিএনপি সদস্য ও ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সাবিরা নাজমুল মুন্নি। এ আসন থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মিজানুর রহমান খান, জেলা বিএনপির নেতা অ্যাডভোকেট ইসহাক, চৌগাছা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি জহুরুল ইসলাম, ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইমরান হাসান সামাদ নিপুন। খুলনা বিভাগের বিএনপি মনোনীত একমাত্র নারী প্রার্থী মুন্নির মনোনয়ন পরিবর্তন চেয়ে মাঠে একজোট হয়েছেন বঞ্চিতরা। তারা ও তাদের বলয়ের নেতাকর্মীরা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মিজানুর রহমান খানের মনোনয়ন চেয়ে কেন্দ্রে লিখিত আবেদন এবং সংসদীয় এলাকায় মিটিং-সিটিং করে চলেছেন।
এদিকে, ধানের শীষের জন্য মাঠে না নেমে বঞ্চিতদের কর্মসূচিতে দেখা যাওয়ায় কেন্দ্র থেকে শোকজ করা হয়েছে ঝিকরগাছা যুবদল, ছাত্রদলের চার নেতাকে। সর্বশেষ যুবদলের ঝিকরগাছা উপজেলা কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে আংশিক কমিটিও দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ধানের শীষের প্রার্থীর পাশে দেখা যায়নি ‘বঞ্চিত-মনোক্ষুণ্ন’ অংশের কারো। তবে তারা শেষ পর্যন্ত দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাবে না বলে কয়েকজন নেতা দাবি করেছেন।
জানতে চাইলে মিজানুর রহমান খান বলেন, মনোনয়ন পরিবর্তনের জন্য
যশোর-২ আসনের ৫৭ জন নেতা কেন্দ্র বরাবর আবেদন করেছেন। তফসিল ঘোষণার ৫-৭ দিনের মধ্যে হয়ত ওই আবেদনের বিষয়ে আলোচনা-সিদ্ধান্ত নিতে পারেন শীর্ষ নেতৃত্ব। সেই অপেক্ষায় আছেন নেতাকর্মীরা। তবে দিন শেষে আমরা ধানের শীষের লোক। আমরা বিএনপির কর্মী।
যশোর-৪ (বাঘারপাড়া-অভয়নগর-বসুন্দিয়া) : এ আসনে ধানের শীষের মনোনয়ন পেয়েছেন কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য টিএস আইয়ুব। মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক নূরে আলম সিদ্দিকী সোহাগ ও শ্রমিকদলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও অভয়নগর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ফারাজী মতিয়ার রহমান। মনোনয়ন না পেয়ে কিছুদিন টিএস আইয়ুবের পক্ষে থেকেছিলেন সোহাগ। পরে অবশ্য তার কর্মকাণ্ড কিছুটা কমে গেছে। আর অপর মনোনয়ন বঞ্চিত ফারাজী মতিয়ার রহমান মনোনয়ন বাতিল বা পরিবর্তনের আশায় লবিং করে যাচ্ছেন। দল মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে কর্মসূচিতে দেখা যাচ্ছে না তার বলয়ের লোকজনকে। কোন কোন নেতা টিএস আইয়ুবের মনোনয়ন বাতিল চেয়ে কর্মসূচি পালন করেন। ফারাজী মতিয়ারকে থামাতে ইতোমধ্যে মতিয়ারসহ নওয়াপাড়া পৌর বিএনপির সভাপতি আবু নইমকে শোকজ করেছে যশোর বিএনপি।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক নূরে আলম সিদ্দিকী সোহাগ বলেন, আমি দল মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ শুরু করেছিলাম। তবে প্রার্থী কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাকে এড়িয়ে চলছেন। প্রার্থী ডাকলে আমি তার সাথে থাকবো। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দলের মহাসচিব সম্প্রতি বলেছেন, প্রার্থী পরিবর্তনের সম্ভাবনা খুবই কম। তবে বাতিল হলে সেখানে প্রার্থী দেয়া হবে।
যশোর-৪ আসনের প্রার্থী ঋণ খেলাপী। তার মনোনয়ন বাতিল হবে এমন আশায় রয়েছেন অভয়নগর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ফারাজী মতিয়ার রহমান। এজন্য তিনি অপেক্ষা করছেন। কেন্দ্র ও তৃণমূলে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।
যশোর-৬ (কেশবপুর) : এ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণ। বঞ্চিত হয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সহধর্মবিষয়ক সম্পাদক অমলেন্দু দাস অপু ও কেশবপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবুল হোসেন আজাদ। প্রায় একযুগ পরে এলাকায় ফিরে শ্রাবণ গণসংযোগ করে যাচ্ছেন। তবে মনোনয়ন বঞ্চিত ও তাদের অনুসারীরা এখনো শ্রাবণের পক্ষে কাজ শুরু করেননি। তারা মনোনয়ন পরিবর্তনের আশায় সভা সমাবেশ ও নানা কর্মসূচি করছেন।
জানতে চাইলে যশোর জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু বলেন, তফসিল ঘোষণার পর সমস্যা কেটে যাবে। যারা প্রার্থীর পক্ষে নামেননি; তাদের সমন্বয় করার চেষ্টা করা হবে। এছাড়াও কেন্দ্র থেকে ইন্সট্রাকশন দিবে। সেই মোতাবেক আমরা কাজ করবো। কোন অসুবিধা হবে না।
প্রতিনিধির নাম 





















