ঢাকা ০৩:৫৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৫, ৮ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
নারায়ণগঞ্জে নিরাপত্তা প্রহরী হত্যা মামলার অন্যতম আসামি পটুয়াখালী থেকে গ্রেপ্তার র‍্যাব-১১ এর তৎপরতায় অবৈধ পলিথিন কারখানায় মোবাইল কোর্টের অভিযান বিজিবির অভিযানে চোলাই মদসহ দুই পাচারকারী আটক কুমিল্লার গোমতীর চরে সারি সারি ফুলকপির গাছ কিছু বিষয়ে উচ্চ আদালতের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে : আসিফ নজরুল গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে মনেপ্রাণে ধারণকারীদের ঐক‍্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম গঠনের তাগিদ এবি পার্টির চাঁপাইনবাবগঞ্জে সড়ক দূর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত (নিহত) পরিবারের মাঝে চেক হস্তান্তর পল্লীবন্ধু এরশাদের হাতে গড়া উপজেলা পরিষদের পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের দাবিতে সুনামগঞ্জে গণমমিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত সিদ্ধিরগঞ্জে ২০০ পিস ইয়াবাসহ এক মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার গাজার ত্রাণে বাধা না দিতে ইসরায়েলকে নির্দেশ আইসিজের

টেকনাফে প্রদীপ–লিয়াকতের অন্ধকার সাম্রাজ্য: খুন, ধর্ষণ, ইয়াবা আর ক্রসফায়ারের বাণিজ্য

  • প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০২:৫৯:৩০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • ১২৭ বার পড়া হয়েছে

টেকনাফ প্রতিনিধি: টেকনাফ—বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের এক ছোট শহর। কিন্তু দীর্ঘ এক যুগ ধরে এ জায়গা পরিণত হয়েছিল এক ভয়ঙ্কর অন্ধকার সাম্রাজ্যে, যার নিয়ন্ত্রক ছিলেন তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশ ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী লিয়াকত আলী।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে তারা গড়ে তুলেছিলেন খুন, ধর্ষণ, ইয়াবা বাণিজ্য, চাঁদাবাজি আর ক্রসফায়ারের এক দুঃশাসন—যার ক্ষত আজও বয়ে বেড়াচ্ছে টেকনাফবাসী।

খুন ও ক্রসফায়ারের আতঙ্ক

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত টেকনাফে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন অন্তত ১৬১ জন।
অভিযোগ রয়েছে, এদের অনেককে আগে আটক করা হয়েছিল। পরিবার থেকে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হতো। টাকা দিতে পারলেই ‘ছাড়া’, আর দিতে না পারলেই পরদিন ‘বন্দুকযুদ্ধের’ গল্প সাজিয়ে লাশ ফিরিয়ে দেওয়া হতো।
এভাবেই ক্রসফায়ার পরিণত হয়েছিল এক নির্মম বাণিজ্যে।

ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন

শুধু খুন নয়, প্রদীপ–লিয়াকতের শাসনামলে ভয়ঙ্কর মাত্রায় বেড়েছিল নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের অভিযোগ। ইয়াবা সিন্ডিকেট কিংবা সাধারণ পরিবার—কেউ নিরাপদ ছিল না।
প্রশাসনের আশ্রয়–প্রশ্রয়ে প্রভাবশালী মহল মেয়েদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালাত, আর মামলা করতে গেলেই ভুক্তভোগী পরিবারকে হুমকি দেওয়া হতো।
এমনকি অনেক নারীকে ইয়াবার মামলায় জড়িয়ে দিয়ে দীর্ঘদিন জেলে রাখার উদাহরণও প্রচুর।

ইয়াবা বাণিজ্যের কেন্দ্র

মিয়ানমার থেকে সাগরপথে আসা ইয়াবার মূল গেটওয়ে ছিল টেকনাফ। প্রদীপ–লিয়াকতের ছত্রছায়ায় এই বাণিজ্য রমরমা হয়ে ওঠে।
স্থানীয় সিন্ডিকেট থেকে মাসিক ভাগ নিত তারা। মাদকবিরোধী অভিযান দেখানোর নামে একপক্ষের ইয়াবা ধ্বংস করে, অন্যপক্ষকে সুরক্ষা দিত। ফলে ইয়াবা পাচারের ভৌগোলিক অবস্থান থেকে টেকনাফ হয়ে ওঠে দেশের সবচেয়ে বড় মাদক করিডর।

চাঁদাবাজি ও ভয়ের রাজত্ব

সাধারণ দোকানদার, জেলে, দিনমজুর, এমনকি প্রবাসী পরিবার—কেউ বাদ যায়নি প্রদীপ–লিয়াকতের চাঁদাবাজির খপ্পর থেকে।
‘কেস তুলে নেওয়া’, ‘ক্রসফায়ার থেকে বাঁচানো’ কিংবা ‘মাদক মামলায় না ফাঁসানো’—এসব অজুহাতে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছিল।
স্থানীয়রা বলছেন, টেকনাফে তখন ন্যায়বিচারের বদলে শাসন চলত টাকার বিনিময়ে।

সিনহা হত্যাকাণ্ডে পতন

২০২০ সালের ৩১ জুলাই অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যা ছিল প্রদীপ–লিয়াকতের পতনের সূচনা।
এই ঘটনার পর তদন্তে বেরিয়ে আসে একের পর এক ভয়ঙ্কর সত্য—খুন, ধর্ষণ, ইয়াবা সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি আর ক্রসফায়ারের বাণিজ্যের চিত্র।
দেশজুড়ে আলোড়ন শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত প্রদীপ–লিয়াকতকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়।

টেকনাফের আজকের বাস্তবতা

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ দাঁড়িয়ে টেকনাফবাসী এখনো সেই ভয়াল দিনগুলো মনে করলে কেঁপে ওঠে। কারো পরিবার হারিয়েছে সন্তান, কারো ঘরে আজও ফিরেনি প্রবাসফেরত ভাই, কেউ আবার জীবনের মূল্য দিয়ে গেছে অন্যায়ের প্রতিবাদ করায়।
প্রদীপ–লিয়াকতের পতন হয়েছে, তবে তাদের রেখে যাওয়া ক্ষত আজও গভীর হয়ে আছে এই সীমান্ত শহরের মানুষের হৃদয়ে।

ট্যাগস :

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

জনপ্রিয় সংবাদ

নারায়ণগঞ্জে নিরাপত্তা প্রহরী হত্যা মামলার অন্যতম আসামি পটুয়াখালী থেকে গ্রেপ্তার

টেকনাফে প্রদীপ–লিয়াকতের অন্ধকার সাম্রাজ্য: খুন, ধর্ষণ, ইয়াবা আর ক্রসফায়ারের বাণিজ্য

আপডেট সময় : ০২:৫৯:৩০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

টেকনাফ প্রতিনিধি: টেকনাফ—বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের এক ছোট শহর। কিন্তু দীর্ঘ এক যুগ ধরে এ জায়গা পরিণত হয়েছিল এক ভয়ঙ্কর অন্ধকার সাম্রাজ্যে, যার নিয়ন্ত্রক ছিলেন তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশ ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী লিয়াকত আলী।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে তারা গড়ে তুলেছিলেন খুন, ধর্ষণ, ইয়াবা বাণিজ্য, চাঁদাবাজি আর ক্রসফায়ারের এক দুঃশাসন—যার ক্ষত আজও বয়ে বেড়াচ্ছে টেকনাফবাসী।

খুন ও ক্রসফায়ারের আতঙ্ক

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত টেকনাফে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন অন্তত ১৬১ জন।
অভিযোগ রয়েছে, এদের অনেককে আগে আটক করা হয়েছিল। পরিবার থেকে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হতো। টাকা দিতে পারলেই ‘ছাড়া’, আর দিতে না পারলেই পরদিন ‘বন্দুকযুদ্ধের’ গল্প সাজিয়ে লাশ ফিরিয়ে দেওয়া হতো।
এভাবেই ক্রসফায়ার পরিণত হয়েছিল এক নির্মম বাণিজ্যে।

ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন

শুধু খুন নয়, প্রদীপ–লিয়াকতের শাসনামলে ভয়ঙ্কর মাত্রায় বেড়েছিল নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের অভিযোগ। ইয়াবা সিন্ডিকেট কিংবা সাধারণ পরিবার—কেউ নিরাপদ ছিল না।
প্রশাসনের আশ্রয়–প্রশ্রয়ে প্রভাবশালী মহল মেয়েদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালাত, আর মামলা করতে গেলেই ভুক্তভোগী পরিবারকে হুমকি দেওয়া হতো।
এমনকি অনেক নারীকে ইয়াবার মামলায় জড়িয়ে দিয়ে দীর্ঘদিন জেলে রাখার উদাহরণও প্রচুর।

ইয়াবা বাণিজ্যের কেন্দ্র

মিয়ানমার থেকে সাগরপথে আসা ইয়াবার মূল গেটওয়ে ছিল টেকনাফ। প্রদীপ–লিয়াকতের ছত্রছায়ায় এই বাণিজ্য রমরমা হয়ে ওঠে।
স্থানীয় সিন্ডিকেট থেকে মাসিক ভাগ নিত তারা। মাদকবিরোধী অভিযান দেখানোর নামে একপক্ষের ইয়াবা ধ্বংস করে, অন্যপক্ষকে সুরক্ষা দিত। ফলে ইয়াবা পাচারের ভৌগোলিক অবস্থান থেকে টেকনাফ হয়ে ওঠে দেশের সবচেয়ে বড় মাদক করিডর।

চাঁদাবাজি ও ভয়ের রাজত্ব

সাধারণ দোকানদার, জেলে, দিনমজুর, এমনকি প্রবাসী পরিবার—কেউ বাদ যায়নি প্রদীপ–লিয়াকতের চাঁদাবাজির খপ্পর থেকে।
‘কেস তুলে নেওয়া’, ‘ক্রসফায়ার থেকে বাঁচানো’ কিংবা ‘মাদক মামলায় না ফাঁসানো’—এসব অজুহাতে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছিল।
স্থানীয়রা বলছেন, টেকনাফে তখন ন্যায়বিচারের বদলে শাসন চলত টাকার বিনিময়ে।

সিনহা হত্যাকাণ্ডে পতন

২০২০ সালের ৩১ জুলাই অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যা ছিল প্রদীপ–লিয়াকতের পতনের সূচনা।
এই ঘটনার পর তদন্তে বেরিয়ে আসে একের পর এক ভয়ঙ্কর সত্য—খুন, ধর্ষণ, ইয়াবা সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি আর ক্রসফায়ারের বাণিজ্যের চিত্র।
দেশজুড়ে আলোড়ন শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত প্রদীপ–লিয়াকতকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়।

টেকনাফের আজকের বাস্তবতা

১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ দাঁড়িয়ে টেকনাফবাসী এখনো সেই ভয়াল দিনগুলো মনে করলে কেঁপে ওঠে। কারো পরিবার হারিয়েছে সন্তান, কারো ঘরে আজও ফিরেনি প্রবাসফেরত ভাই, কেউ আবার জীবনের মূল্য দিয়ে গেছে অন্যায়ের প্রতিবাদ করায়।
প্রদীপ–লিয়াকতের পতন হয়েছে, তবে তাদের রেখে যাওয়া ক্ষত আজও গভীর হয়ে আছে এই সীমান্ত শহরের মানুষের হৃদয়ে।